নবী ও রসূলের মধ্যে পার্থক্য কী
এখানে একটি মাস‘আলা বর্ণনা করা আবশ্যক। তা হলো নবী ও রসূলের মধ্যে পার্থক্য কী? নবী ও রসূলের মধ্যে পার্থক্য আছে কি না এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ মতটি হলো, রসূল বলা হয় এমন পুরুষকে যার নিকট আল্লাহ তা‘আলা নতুন শরী‘আত পাঠিয়েছেন এবং তাকে সেটা প্রচার করার আদেশ দেয়া হয়েছে। আর নবী হলেন এমন পুরুষ, যার নিকট অহী প্রেরণ করা হয়েছে, কিন্তু তাবলীগ করার আদেশ করা হয়নি। সুতরাং প্রত্যেক নবী ও রসূলের নিকটই অহী এসেছে। কিন্তু নবীকে পাঠানো হয়েছে মুমিন সম্প্রদায়ের প্রতি পূর্বের শরী‘আতসহ। যেমন বনী ইসরাঈলের নবীদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাদের সকলকেই তাওরাতের শরী‘আত দিয়ে বনী ইসরাঈলদেরকে পরিচালনা করার আদেশ দেয়া হয়েছে। তবে তাদের কারো কারো নিকট নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে খাস অহীও করা হয়েছে।
আর রসূলদেরকে পাঠানো হয়েছে কাফের সম্প্রদায়ের নিকট। তারা কাফেরদেরকে আল্লাহর তাওহীদের দিকে এবং তার ইবাদতের দিকে ডাকতেন। সুতরাং রসূলগণ প্রেরিত হতেন অবিশ্বাসী বিরুদ্বাচরণকারী কাফেরদের নিকট। কোনো কোনো কাফের সম্প্রদায় তাদেরকে মিথ্যুক বলতো। রসূলদের মর্যাদা নবীদের মর্যাদার চেয়ে অধিক। রসূলগণের মর্যাদার মধ্যেও তারতম্য রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ۘ مِّنْهُم مَّن كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ﴾
‘‘এ রসূলদের একজনকে আরেকজনের উপর মর্যাদাশালী করেছি। তাদের কারোর সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন, কাউকে তিনি উন্নত মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন’’। (সূরা বাকারা: ২৫৩) রসূলদের মধ্যে সর্বোত্তম হলেন أولو العزم অর্থাৎ আল্লাহর দিকে দাওয়াত প্রচারে সুদৃঢ় ইচ্ছার অধিকারী রসূলগণ।[1]
তারা হলেন নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াতে তাদের কথা উল্লেখ করেছেন,
﴿وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُوحٍ وَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا﴾
‘‘হে নবী! ম্মরণ করো সেই অঙ্গীকারের কথা যা আমি নিয়েছি সকল নবীর কাছ থেকে, তোমার কাছ থেকে, নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মরিয়াম পুত্র ঈসার কাছ থেকে। সবার কাছ থেকে আমি নিয়েছি পাকাপোক্ত অঙ্গীকার’’। (সূরা আহযাব: ৭) আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে একসাথে উল্লেখ করে আরো বলেন,
﴿شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ﴾
‘‘তিনি তোমাদের জন্য দীনের সেসব নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং যা আমি তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছি আমি ইবরাহীম, মূসা, ও ঈসা আলাইহিমুস সালামকে। এ আদেশ দিয়েছিলাম যে, তোমরা দীন কায়েম করো এবং তাতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’’। (সূরা শূরা: ১৩)
উলুল আযম রসূলদের মধ্যে দুই খলীল তথা ইবরাহীম ও মুহাম্মাদ আলাইহিমাস সালাম সর্বোত্তম। সম্মান ও মর্যাদার দিক দিয়ে তাদের পরে ছিলেন অন্যান্য রসূলগণ। অতঃপর নবীগণ। দুই খলীলের মধ্যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন উত্তম।
নবী-রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়নের পর আমাদেরকে জানতে হবে যে, নবুওয়াত আল্লাহর পক্ষ হতে একটি অনুগ্রহ। আল্লাহ তা‘আলাই তার বান্দাদের মধ্য থেকে কাউকে নবী হিসাবে বাছাই করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ﴾
‘‘আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য থেকে বাণীবাহক বাছাই করেন এবং মানুষদের মধ্য থেকেও। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা হজ্জ: ৭৫)
নবুওয়াত এমন কোনো সম্মান জনক পদমর্যাদা নয়, যা বান্দা ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে পরিশ্রম করে অর্জন করতে পারে। নবুওয়াত এমন কোনো সম্পদ নয়, যা আনুগত্যের কাজে কঠোর পরিশ্রম, আত্মশুদ্ধির অভ্যাস, অন্তর পরিস্কার, চরিত্র সংশোধন এবং অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। যেমন দার্শনিকগণ বলে থাকে যে, পরিশ্রম করে নবুওয়াত অর্জন করা যায়। তাদের ধারণা হলো, আত্মশুদ্ধি ও অনুশীলনীর মাধ্যমে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন কামালিয়াত বা পূর্ণতা অর্জন করার পর নিয়মিত আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনগুলোর প্রতি কেউ যখন গভীর অন্তর্দিষ্টি দিতে থাকবে, তখন তার হৃদয়ের আয়না প্রস্ফুটিত হবে, তার জ্ঞানের দৃষ্টি উন্মুক্ত হবে এবং তার জন্য এমন কিছু অর্জন করা সম্ভব হবে, যা অন্যদের জন্য হবে না।
দার্শনিকদের মতে নবুওয়াতের জন্য তিনটি শক্তি থাকা দরকার।
(১) এমন শক্তিশালী ইলম থাকা চাই, যাতে শিক্ষক ছাড়াই স্বীয় শক্তির মাধ্যমে ইলম অর্জন করতে সক্ষম হয়।
(২) এমন কল্পনাশক্তি থাকা আবশ্যক, যার মাধ্যমে মানুষ নিজের মধ্যে বিভিন্ন রকম এমন নূরানী চেহারা কল্পনা করতে পারে, যা তাকে সম্বোধন করে এবং সে উক্ত নূরানী চেহারার কথা শুনতে পায়।
(৩) মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা থাকা আবশ্যক। এ শক্তিকে তারা সৃষ্টিজগতের মৌলিক বস্তুতে হস্তক্ষেপ ও কর্তৃত্বকারী শক্তি হিসাবে নামকরণ করে থাকে। দার্শনিকদের মতে এ ছিফাতগুলো অর্জন করা সম্ভব।
এমন বিভ্রান্তিকর বক্তব্যকে পুঁজি করে কতিপয় সুফী নবুওয়াত দাবি করেছে। তাদের মতে নবুওয়াত সাধারণ একটি পেশা মাত্র। এটি একটি সম্পূর্ণ বাতিল কথা। আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণী তাদের কথাকে প্রত্যাখ্যান করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা সূরা আনআমের ১২৪ নং আয়াতে বলেন,
﴿قَالُوا لَن نُّؤْمِنَ حَتَّىٰ نُؤْتَىٰ مِثْلَ مَا أُوتِيَ رُسُلُ اللَّهِ اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ﴾
‘‘তারা বলে, আল্লাহর রসূলদেরকে যা দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তা আমাদের দেয়া হয় ততক্ষণ আমরা ঈমান আনয়ন করবো না। আল্লাহর নিজের রিসালাত কাকে দিবেন তা তিনিই সর্বাধিক অবগত আছেন’’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ﴾
আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য থেকেও বাণীবাহক বাছাই করেন এবং মানুষদের মধ্য থেকেও। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা হজ্জ: ৭৫)
সুতরাং নবুওয়াত আল্লাহ তা‘আলার হিকমত অনুযায়ী এবং সেটার জন্য কে উপযুক্ত সে অনুপাতেই তার পক্ষ হতে নির্বাচিত হয়ে থাকে। বান্দা এটি উপার্জন করতে সক্ষম নয়।
তবে এ কথা সঠিক যে, নবীগণের এমন ফযীলত রয়েছে, যার মাধ্যমে তারা অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্টের অধিকারী হয়েছেন। তবে বিভ্রান্ত দার্শনিকরা নবুওয়াতের যে ব্যাখ্যা দেয়, সেটা মোটেই সেরকম নয়।
[1]. তারা ছিলেন ঐ সমস্ত রাসূল, যারা রেসালাতের দায়িত্ব পালনে ছিলেন পর্বত সদৃশ সুদৃঢ় ইচ্ছা শক্তি সম্পন্ন এবং আল্লাহর তাওহীদের দাওয়াত প্রচার করতে গিয়ে নিজ নিজ গোত্রের পক্ষ হতে যেসব যুলুম-নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন তাতে সীমাহীন ধৈর্যধারণকারী।
দালায়েলুন নুবুওয়াত বলতে এমনসব দলীল-প্রমাণ উদ্দেশ্য, যার মাধ্যমে সত্য নবীর নবুওয়াত সম্পর্কে জানা যায় এবং নবুওয়াতের মিথ্যুক দাবিদারদের মিথ্যাবাদিতা জানা যায়। সে হিসাবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নবুওয়াতের অনেক দলীল-প্রমাণ রয়েছে, যা গণনা করে শেষ করা যাবে না। নিম্নে কতিপয় দলীল বর্ণনা করা হলো।
(১) المعجزة মুজিযা অক্ষমকারী: القدرة (ক্ষমতা) এর বিপরীত অর্থবোধক শব্দ العجز (অক্ষমতা) থেকে المعجزة শব্দটি ইসমে ফায়েল হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অভিধান গ্রন্থে নবীর মুজিযা বলতে এমন জিনিস বুঝানো হয়েছে, যা দ্বারা তিনি চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় প্রতিপক্ষকে অক্ষম করে দিতে পারেন। المعجزة শব্দের মধ্যকার তা বর্ণটি আধিক্য বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
আর ইসলামের পরিভাষায় মুজিযা হলো সাধারণ অভ্যাসের বিপরীত এমন বিষয়, যা আল্লাহ তা‘আলা নবীর হাতে প্রকাশ করে থাকেন। উদ্দেশ্য হলো এর মাধ্যমে তিনি নবীর সত্যতা ও তার রিসালাতের বিশুদ্ধতা প্রমাণ করেন।
নবী রসূলদের অনেক মুজিযা রয়েছে। যেমন সালেহ আলাইহিস সালামের উটনী। তার গোত্রের লোকদের উপর হুজ্জত কায়েম করার জন্য তিনি তাকে তা দান করেছিলেন। মূসা আলাইহিস সালামের নবুওয়াতের দলীল হিসাবে হাতের লাঠিকে আল্লাহ তা‘আলা সাপে পরিণত করেছিলেন। জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে ভালো করা এবং মৃতদেরকে জীবিত করা ছিল ঈসা আলাইহিস সালামের মুজিযা।
আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরও রয়েছে অনেক মুজিযা। তার মুজিযাসমূহের মধ্যে কুরআনুল কারীম হলো সবচেয়ে বড় মুজিযা। এ চিরন্তন মুজিযার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা জিন ও ইনসানকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। ইসরা ও মিরাজ, চন্দ্র দ্বিখ–ত করা, তার হাতের তালুতে পাথরের তাসবীহ পাঠ করা, খেজুর গাছের গুড়ির তার বিচ্ছেদে কান্নাকাটি করা এবং অতীত ও ভবিষ্যতের কিছু কিছু ঘটনা সম্পর্কে সংবাদ প্রদান করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম মুজিযা।
তর্কশাস্ত্রবিদরা বলে থাকে যে, নবুওয়াতের দলীল-প্রমাণ শুধু মুজিযার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সঠিক কথা হচ্ছে, তা কেবল মুজিযার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা অসংখ্য। তার মধ্যে রয়েছে,
(১) নবীগণ তাদের জাতির লোকদেরকে সুসংবাদ দিয়েছেন যে, তারা অচিরেই বিজয়ী হবেন, তাদের শত্রুরা ধ্বংস হবে এবং শুভ পরিণাম তাদেরই হবে। নবীগণ যে সংবাদ দিয়েছেন, তাই হয়েছে। তাদের একটি সংবাদও মিথ্যা হয়নি। যেমন হয়েছিল নূহ আলাইহিস সালাম, হুদ আলাইহিস সালাম, সালেহ আলাইহিস সালাম, শুআইব আলাইহিস সালাম, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, লুত আলাইহিস সালাম, মূসা আলাইহিস সালাম এবং আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংবাদগুলোর ক্ষেত্রে। আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে এ সংবাদ দিয়েছেন।
(২) নবীগণ যে শরী‘আত ও সংবাদ নিয়ে এসেছেন, তা দৃঢ়তা, নিপুণতা, সত্যবাদিতা এবং সৃষ্টির জন্য সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করায় পূর্ণতম। বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে জানা যায় যে, সর্বাধিক জ্ঞানী ও সৎ লোক ছাড়া অন্য কারো মাধ্যমে এ রকম সুনিপুন কথা প্রকাশিত হওয়া সম্ভব নয়।
(৩) নবীদের আরেকটি মুজিযা হলো আল্লাহ তা‘আলা সবসময় তাদেরকে সাহায্য করেন। আল্লাহ তা‘আলার সুন্নাত (রীতি-নীতি) থেকে অবগত হওয়া গেছে যে, সত্যবাদীকে তিনি যেভাবে সাহায্য করেন মিথ্যাবাদীকে সেভাবে সাহায্য করেন না। বরং তিনি বিথ্যাবাদীকে লাঞ্ছিত করেন। তবে কখনো কখনো তাকে অবকাশ দেয়া হয়। অতঃপর ধ্বংস করেন।
(৪) আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ও আনুগত্য করা এবং শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনয়ন করা, সমস্ত আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ও রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়ন করার ব্যাপারে সমস্ত নবী-রসূলের তরীকা মাত্র একটি। তাদের এক ও অভিন্ন কাজের বিরোধিতা করা কারো জন্য বৈধ নয়। তাদের পরবর্তীগণ পূর্ববর্তীদেরকে সত্যায়ন করেন এবং পূর্ববর্তীগণ পরবর্তীদের আগমণের সুসংবাদ প্রদান করেন। যেমন ঈসা আলাইহিস সালাম মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমণের সুসংবাদ দিয়েছেন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পূর্বের সমস্ত নবীকে সত্যায়ন করেছেন।
(৬) নবুওয়াতের আরেকটি দলীল হলো, আল্লাহ তা‘আলা নবীদেরকে সাহায্য করেন। আল্লাহ তা‘আলার চিরন্তন রীতি-নীতি সম্পর্কে অবগত হওয়া গেছে যে, তিনি সত্যাবাদীকে সাহায্য করার মত মিথ্যাবাদীকে সাহায্য করেন না। বরং মিথ্যুককে তিনি অপমানিত ও লাঞ্ছিত করেন, তাকে সাহায্য করেন না। বরং তাকে ধ্বংস করেন। তিনি যদি কোনো প্রভাবশালী যালেমকে কখনো সাহায্য করেন, তাহলে সে নবুওয়াত দাবি করে না এবং আল্লাহর নামে মিথ্যাও বলে না। বরং সে এমন যালেম হয়, যাকে আল্লাহ তা‘আলা তার মতই অন্য যালেমের উপর শক্তিশালী ও সক্ষম করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَكَذَلِكَ نُوَلِّي بَعْضَ الظَّالِمِينَ بَعْضًا بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ﴾
‘‘এভাবেই আমি কতক যালেমকে অন্যসব যালেমের উপর শক্তিশালী করে দেই তাদের কৃতকর্মের কারণে’’। (সূরা আল আনআম: ১২৯)
যারা বলে আল্লাহ তা‘আলা মিথ্যুক লোককে রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন, তাদের কথা সত্যের বিপরীত। কেননা মিথ্যুকের জন্য আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত থাকেনা। তবে তিনি কিছুকাল তাকে অবকাশ দেন। অতঃপর তাকে ধ্বংস করেন। আরেকটি কথা হলো নবুওয়াতের দাবি ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে সত্যবাদী মানুষ ও মিথ্যুক মানুষের মধ্যে পার্থক্য করার অনেক পদ্ধতি রয়েছে। সুতরাং নবুওয়াতের সত্য দাবিদার এবং মিথ্যুক দাবিদারের মধ্যে পার্থক্য করার উপায় থাকবে না কেন?
এ কথা সকলের জেনে রাখা আবশ্যক যে, রিসালাতের দাবিদার হয়ত মানুষের মধ্যে সর্বাধিক শ্রেষ্ঠ হবে অথবা তাদের মধ্যে সর্বাধিক নিকৃষ্ট হবে। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ছাকীফ গোত্রে গেলেন এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন তখন তাদের জনৈক নেতা তাকে বলেছিল, আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে একটি কথাও বলবোনা। তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তাহলে আমার দৃষ্টিতে তোমার কথার প্রতিবাদ করা অনর্থক। আর যদি তুমি মিথ্যুক হয়ে থাকো, তাহলে আমার দৃষ্টিতে তুমি এত নিকৃষ্ট যে, তোমার কথা প্রতিবাদের যোগ্য নয়।
নবুওয়াত সাধারণত সৃষ্টির সেরা ব্যক্তি এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তিই দাবি করে। সুতরাং সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির বিষয়টি কিভাবে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি থেকে অস্পষ্ট হতে পারে! মিথ্যুকদের যে কেউ নবুওয়াত দাবি করেছে, তার মিথ্যাবাদিতা, মূর্খতা, পাপাচার এবং তার উপর শয়তান বিজয়ী হওয়ার বিষয়টি সামান্য বিবেক-বুদ্ধিমান লোকের নিকটও সুস্পষ্ট হয়েছে। আর নবুওয়াতের প্রত্যেক সত্য দাবিদার থেকে এমন জ্ঞান, সত্যবাদিতা, সৎ আমল এবং বিভিন্ন প্রকার কল্যাণ প্রকাশিত হয়েছে, যার মাধ্যমে সামান্যতম বিবেক-বুদ্ধিমান লোকের কাছেও তার সত্যবাদিতা সুস্পষ্ট হয়েছে। কেননা রসূলগণ অবশ্যই মানুষকে অনেক বিষয়ের সংবাদ দেন, অনেক কাজের আদেশ দেন এবং তারা অবশ্যই অনেক কাজ-কর্ম সম্পাদন করেন। মিথ্যুকরা যা বলে, যা আদেশ দেয়, যেসব বিষয়ের সংবাদ দেয় এবং তারা যেসব কাজ-কর্ম করে, তা থেকেই বিভিন্নভাবে তাদের মিথ্যাবাদিতা ধরা পরে। তাদের মিথ্যাবাদিতা সাব্যস্ত করতে বাইরের কোনো দলীলের প্রয়োজন হয় না।
কেউ কেউ প্রশ্ন করে, নবুওয়াতের দলীল-প্রমাণ এবং যাদুকর, গণক ও সাম্প্রতিক কালের বিস্ময়কর আবিষ্কারের মধ্যে পার্থক্য কী?
এ প্রশ্নের জবাব হলো, নবুওয়াতের দলীল-প্রমাণ এবং যাদুকর, গণক ও সাম্প্রতিক কালের বিস্ময়কর আবিস্কারের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
(১) নবী-রসূলদের কথার মধ্যে কোনো খেলাপী কিংবা ভুল হয় না। কিন্তু গণক ও জ্যোতিষীর সংবাদ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাদের অধিকাংশ সংবাদ মিথ্যা হয়। তবে শয়তানদের চুরি করা কথা থেকে গণকরা যা শুনে তার মধ্য থেকে কিছু কিছু বিষয়ে তাদের কথা কখনো কখনো সত্য হয়।
(২) যাদুকর ও গণকের কাজ-কারবার এবং আধুনিক আবিস্কারের বিষয়গুলো মানুষের নিকট খুবই স্বাভাবিক ও পরিচিত। মানুষ এগুলো শিখতে পারে। এগুলো মানুষ ও জিনের ক্ষমতার বাইরে নয়। সমপর্যায়ের বিষয় দ্বারা এগুলোর মোকাবেলা করা সম্ভব। কিন্তু নবীদের নিদর্শন ও মুজিযার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এগুলোর মোকাবেলা করা কোনো জিন-ইনসানের পক্ষে সম্ভব নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لاَ يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا﴾
‘‘হে নবী! বলো, সমস্ত মানব ও জিন যদি এ কুরআনের অনুরূপ রচনা করার জন্য জড়ো হয় এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনো এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না’’। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৮৮)
সুতরাং সৃষ্টির পক্ষে নবীদের নিদর্শনের অনুরূপ কিছু আনয়ন করা সম্ভব নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলাই নবীদের সত্যবাদিতার জন্য নিদর্শন ও আলামত নির্ধারণ করেন। যেমন চন্দ্র দ্বিখ–ত করা, হাতের লাঠিকে সাপে পরিণত করা, পাথরের তাসবীহ শ্রবণ করা, খেজুর কাঠের বিরহ-বিচ্ছেদের বেদনা মূলক ক্রন্দনের আওয়াজ শ্রবণ করা এবং সামান্য পরিমাণ পানি ও খাদ্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয় সংঘটিত করা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো ক্ষমতাধীন নয়।
(৩) নবীগণ ঈমানদার মুসলমান হয়ে থাকেন। তারা এক আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী ইবাদত-বন্দেগী করেন। তারা সমস্ত নবীর আনীত দীনকে সত্যায়ন করেন। অপর পক্ষে যাদুকর, গণক এবং ভ- নবীরা কাফের, মুশরেক এবং আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি কুফুরী করে।
(৪) সৃষ্টিগত স্বভাব এবং বিবেক-বুদ্ধি নবী-রসূলদের আনীতি দীনকে সমর্থন করে। ঐদিকে যাদুকর, গণক ও মিথ্যুক দাজ্জালদের কাজকর্ম শরী‘আতের দলীল এবং বিবেক-বুদ্ধি ও সৃষ্টিগত স্বভাবের পরিপন্থী।
(৫) নবী-রসূলগণ এসেছেন মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব ও বিবেক-বুদ্ধিকে পূর্ণতা প্রদান করার জন্য। বিপরীত পক্ষে যাদুকর, গণক ও মিথ্যুকরা মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও সৃষ্টিগত পরিশুদ্ধ স্বভাবকে নষ্ট করে দেয়।
(৬) নবীদের মুজিযা তাদের নিজস্ব কাজের ফসল নয়। নবুওয়াতের আলামত ও নিদর্শন স্বরূপ এটি আল্লাহ তা‘আলাই তাদেরকে দান করেন। যেমন চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা, হাতের লাঠিকে সাপে পরিণত করা, কুরআন প্রদান করা এবং আল্লাহ তা‘আলার নিজস্ব ছিফাত ইলমুল গায়েবের খবর প্রদান করা। সুতরাং নিদর্শন প্রদান করার বিষয়টি সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহর হাতে। এতে সৃষ্টির কোনো হাত নেই। মুশরেকরা যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিদর্শন চাইলো, তখন আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে বললেন,
﴿قُلْ إِنَّمَا الْآيَاتُ عِندَ اللَّهِ وَإِنَّمَا أَنَا نَذِيرٌ مُّبِينٌ﴾
‘‘বলো, নিদর্শনাবলী তো রয়েছে আল্লাহর কাছে এবং আমি কেবলমাত্র সুস্পষ্ট সতর্ককারী’’। (সূরা আনকাবুত: ৫০) আর যাদুকর, গণক এবং শিল্প ও কারিগরি বিষয়ক আধুনিক আবিস্কার সম্পর্কে কথা হলো এগুলো সৃষ্টির কাজের অন্তর্ভুক্ত।
উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও নবীদের মুজিযা এবং যাদুকর ও গণকদের ভেলকিবাজির মধ্যে পার্থক্য করার অনেক উপায় রয়েছে। যে এ বিষয়ে অধিকতর জানতে চান, তিনি যেন শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহর النبوات নামক কিতাবটি অধ্যায়ন করে।