الشرك الأصغر – বা ছোট শিরক

الشرك الأصغر – বা ছোট শিরক

ছোট শিরক তাওহীদের মধ্যে ঘাটতি আনয়ন করে এবং সেটাকে ত্রুটিযুক্ত করে দেয়। মানুষের মধ্যে এমন অনেক ছোট শিরক রয়েছে, যা থেকে আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সতর্ক করেছেন। যাতে করে আকীদার সংরক্ষণ করা যায় এবং তাওহীদের হেফাযত করা হয়। কেননা এ ছোট শিরকগুলো তাওহীদে ঘাটতি আনয়ন করে। কখনো কখনো এগুলো বড় শিরকের দিকে নিয়ে যায়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَلاَ تَجْعَلُواْ لِلّهِ أَندَاداً وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ﴾

‘‘অতএব তোমরা জেনে শুনে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থাপন করো না’’। (সূরা আল বাকারা: ২২)

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, অত্র আয়াতে الأنداد বলতে এমন শিরক উদ্দেশ্য, যা আঁধার রাতে কালো পাথরের উপর দিয়ে পীপড়ার চলাচলের অপেক্ষা অধিক গোপনে সংঘটিত হয়। যেমন লোকেরা বলে থাকে আল্লাহর শপথ এবং তোমার জীবনের শপথ, হে অমুক! আমার জীবনের শপথ! এ ছোট্ট কুকুরটি ঘেউ ঘেউ না করলে আমাদের ঘরে চোর প্রবেশ করতো, ঘরে হাঁসগুলো তই তই না করলে আজ রাতে চোর আসতো, কেউ তার সাথীকে বলে থাকে, তুমি যা চাও এবং আল্লাহ তা‘আলা যা চান এবং কোনো কোনো মানুষ বলে থাকে আল্লাহ না থাকলে এবং অমুক না থাকলে এমন হতো না। ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, তুমি কোনো ব্যাপারে অমুক অমুক বলবে না। এসবই শিরকের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম ইবনে আবী হাতিম হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

ইবনে আব্বাসের মতে উপরোক্ত বিষয়গুলো শিরকের মধ্যে গণ্য। আর শিরক বলতে ছোট শিরক উদ্দেশ্য। তবে আয়াত ছোট ও বড় উভয় প্রকার শির্কেই শামিল করে। ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু এসব বিষয় থেকে সর্বাধিক ছোট শিরক সম্পর্কে সতর্ক করার মাধ্যমে সবচেয়ে বড় শিরক থেকে সতর্ক করেছেন। কেননা এ শব্দগুলো অনেক মানুষের জবানে উচ্চারিত হতে দেখা যায়। তাদের কেউ অজ্ঞতা বশত আবার কেউ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এগুলো উচ্চারণ করে থাকে। এ ছোট শিরকগুলোর মধ্যে রয়েছে,

(১) الحلف بغير الله عز وجل আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা

আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা শিরক। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল­াম বলেছেন,   مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْكَفَرَ أَوْ أَشْرَك  ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করল, সে কুফুরী করলো অথবা শিরক করল’’। ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করার পর হাসান বলেছেন এবং আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকেম এটিকে সহীহ বলেছেন।

‘‘সে কুফুরী করলো অথবা শিরক করলো’’: এখানে বর্ণনাকারী সন্দেহ পোষণ করেছেন। অথবা শব্দটি এবং অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে। তখন অর্থ হবে সে কুফুরী করলো এবং শিরক করলো। তবে এটি বড় কুফুরীর চেয়ে কম মানের কুফুরী। এটি ছোট শিরকও বটে।

বর্তমান সময়ের অনেক মানুষই আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করে। তারা আমানতের নামে কসম খায়, নবীর নামে শপথ করে, কেউ কেউ বলে আমার জীবনের কসম, হে অমুক! তোমার জীবনের শপথ! এ ধরণের আরো অনেক শব্দ তারা ব্যবহার করে। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করার নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যেসব হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, আমরা তা শুনলাম। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করাকে কুফুরী অথবা শিরক হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। কেননা কোনো জিনিষের শপথ করার অর্থ হলো উক্ত জিনিসকে সম্মান করা। সুতরাং যাকে সম্মান করা আবশ্যক এবং যার নামে শপথ করা যায় তিনি হলেন আল্লাহ তা‘আলা। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা শিরক এবং বিরাট অপরাধ।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,

لَأَنْ أَحْلِفَ بِاللهِ كَاذِبًا أحَبَّ إليَّ مِنْ أحْلِفَ بِغَيْرِهِ صَادِقًا

‘‘আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম করা আমার কাছে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে সত্য কসম করার চেয়ে বেশী পছন্দনীয়। ইহা জানা কথা যে, আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করা কবীরা গুনাহ। কিন্তু শিরক করা যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা সমস্ত কবীরা গুনাহর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ কবীরা গুনাহ। যদিও তা শির্কে আসগার বা ছোট শিরক হয়।

সুতরাং মুসলিমদের সতর্ক হওয়া আবশ্যক। জাহেলী যুগের অভ্যাস যেন পুনরায় তাদের কাছে ফিরে না আসে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল­াম বলেন,

لاَ تَحْلِفُوا بِآبَائِكُمْ ‘‘তোমরা তোমাদের বাপ-দাদার নামে কসম করো না’’। এ ছাড়া আরো অনেক দলীল রয়েছে। যা আমাদেরকে আদেশ করে যে, আমরা যখন শপথ করার ইচ্ছা করবো, তখন যেন একমাত্র আল্লাহর নামের সাথেই কসমকে সীমিত রাখি এবং তিনি ছাড়া অন্যের নামে শপথ না করি।

যে ব্যক্তি আল্লাহর নামে কসম করার পরও সন্তুষ্ট হয় না, তার ব্যাপারে যা বর্ণিত হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল­াম বলেছেন,

مَنْ حَلَفَ بِاللَّهِ فَلْيَصْدُقْ وَمَنْ حُلِفَ لَهُ بِاللَّهِ فَلْيَرْضَ وَمَنْ لَمْ يَرْضَ بِاللَّهِ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নামে কসম করে, সে যেন সত্য বলে। আর যে ব্যক্তির জন্য আল্লাহর নামে কসম করা হবে, সে যেন উক্ত কসমে সন্তুষ্ট থাকে। আল্লাহর কসমে যে ব্যক্তি সন্তুষ্ট হলো না, তার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই’’। ইমাম ইবনে মাজাহ হাসান সনদে এটি বর্ণনা করেছেন।[1]


[1]. এ হাদীছের সনদে দুর্বলতা থাকলেও তার মর্মার্থ গ্রহণ করতে কোন অসুবিধা নেই। কেননা সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে এ বিষয়ে একাধিক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«أَلا مَنْ كَانَ حَالِفًا فَلا يَحْلِفْ إِلاَّ بِاللَّهِ فَكَانَتْ قُرَيْشٌ تَحْلِفُ بِآبَائِهَا، فَقَالَ:«لاَ تَحْلِفُوا بِآبَائِكُمْ»

‘‘খবরদার যে ব্যক্তি শপথ করতে চায়, সে যেন আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ না করে। কুরাইশরা তাদের বাপদাদার নামে শপথ করতো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কথার প্রতিবাদ করে বললেন, তোমরা তোমাদের বাপদাদাদের নামে শপথ করো না’’। (বুখারী, হাদীছ নং- ৩৮৩৬)

 

(২) শব্দের মাধ্যমে ছোট শিরক হয়ে থাকে

(৩) নিয়ত ও উদ্দেশ্যের মধ্যে ছোট শিরক

(৪) যামানা কিংবা অন্যান্য সৃষ্টিকে গালি দেয়া

(৫) কোনো কোনো অবস্থায় لو (যদি) শব্দ উচ্চারণ করা

এমন কিছু শব্দ রয়েছে, যা উচ্চারণ করা মোটেই ঠিক নয়। কারণ এটি মানুষের আকীদা নষ্ট করে। বিশেষ করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে لَوْ শব্দটি ব্যবহার করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। মানুষ যখন অপ্রিয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় কিংবা মুছীবতে পড়ে তখন সে যেন এমন না বলে, আমি যদি এমন করতাম, তাহলে আমার এ বিপদ হতো না! আমি যদি এমন না করতাম, তাহলে আমার এমন হতো না। কেননা এ ধরণের কথার মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, বান্দার যা হাতছাড়া হলো এবং যা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় তাতে তার ধৈর্য নেই। সেই সঙ্গে যে ব্যক্তি لو শব্দটি উচ্চারণ করে, তার কথার মধ্যে আরো ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, তাক্বদীর ও আল্লাহ তা‘আলার ফায়ছালার প্রতি তার ঈমান নেই। এতে নিজের নফস্কে দোষারোপ করা এবং কুমন্ত্রণা ও দুশ্চিন্তা প্রদানের জন্য শয়তানকে সুযোগ করে দেয়া হয়।

কোনো মুসলিমের উপর মুছীবত নেমে আসলে তাক্বদীরকে মেনে নেয়া এবং মুছীবতে সবর করা আবশ্যক। তবে নিজের নফস্কে দোষারোপ না করে কল্যাণ আনয়নকারী উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করা এবং অকল্যাণ প্রতিহতকারী ও অপ্রিয় বস্তু বিদূরিতকারী উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা জরুরী।

উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের উপর যে বিপদাপদ নেমে এসেছিল, তার কারণে যারা لو শব্দটি ব্যবহার করেছিল, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা দোষারোপ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿يَقُولُونَ لَوْ كَانَ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ مَا قُتِلْنَا هَاهُنَا﴾

‘‘তারা বলে, এ ব্যাপারে যদি আমাদের করণীয় কিছু থাকতো, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতাম না’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৫৪)

উহুদ যুদ্ধের দিন মুসলিমদের উপর যখন মুছীবত নেমে আসলো, তখন কতিপয় মুনাফেক তাক্বদীরের বিরোধীতা করে উপরোক্ত কথা বলেছে। শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য বের হওয়ার কারণে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলিমদেরকে দোষারোপ করছিল। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথার জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন,

 ﴿قُل لَّوْ كُنتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ لَبَرَزَ الَّذِينَ كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقَتْلُ إِلَىٰ مَضَاجِعِهِمْ﴾

 ‘‘ওদেরকে বলে দাও, তোমরা যদি নিজেদের গৃহে অবস্থান করতে তাহলেও যাদের মৃত্যু লেখা হয়েছিল, তারা নিজেরাই নিজেদের বধ্যভূমির দিকে এগিয়ে আসতো’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৫৪) এটি হলো আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত তাক্বদীর, যা সংঘটিত হবেই। গৃহে অবস্থান করে এ থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।

মুছীবত আসার পর لو শব্দ ব্যবহার করলে আফসোস করলে দুঃশ্চিন্তা, নিজের নফ্সকে দোষারোপ করা এবং দুর্বলতা বৃদ্ধি করে। এতে করে মানুষের আকীদার উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং তাদের মধ্যে তাক্বদীর না মানার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এসব মুনাফেকদের সম্পর্কে আরেকটি কথা বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীর মধ্যে তাদের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন,

﴿الَّذِينَ قَالُوا لِإِخْوَانِهِمْ وَقَعَدُوا لَوْ أَطَاعُونَا مَا قُتِلُوا﴾ 

‘‘এরা নিজেরা বসে থাকলো এবং এদের ভাই বন্ধুদের সম্পর্কে বললো, তারা যদি আমাদের কথা মেনে নিতো, তাহলে তারা নিহত হতো না’’ (সূরা আলে ইমরান:১৬৮)।

মুনাফেকরা উহুদ যুদ্ধের দিন এ কথা বলেছিল। বর্ণনা করা হয় যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাক্বদীরের উপর আপত্তি করে বলেছিল, তারা যদি আমাদের পরামর্শ মেনে নিয়ে নিজ নিজ গৃহে বসে থাকতো এবং উহুদের দিকে বেরিয়ে না যেতো, তাহলে তারা নিহত হতো না। আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথার প্রতিবাদ করে বলেছেন,

﴿قُلْ فَادْرَءُوا عَنْ أَنفُسِكُمُ الْمَوْتَ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾

‘‘তোমরা নিজেদের কথায় যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তাহলে তোমাদের নিজেদের মৃত্যু যখন আসবে তখন তা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করো’’(সূরা আলে ইমরান:১৬৮)।

অর্থাৎ ঘরে বসে থাকা এবং যুদ্ধের ময়দানে না যাওয়াই যখন কারো মৃত্যু বরণ করা কিংবা নিহত হওয়া থেকে বেঁচে যাওয়ার কারণ, তাই তোমাদের মৃত্যু বরণ করা উচিত নয়। আসল কথা হলো তোমরা যেখানেই থাকো না কেন মৃত্যু তোমাদের কাছে আসবেই। সুতরাং তোমাদের দাবিতে যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো যে, যারা তোমাদের কথা মেনে নিবে, তারা মৃত্যু থেকে বেঁচে যাবে, তাহলে নিজেদের উপর থেকে মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখো।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবনে উবাই উহুদ যুদ্ধের দিন মুসলিমদের জামা‘আত থেকে কেটে পড়ার সময় বলল, মুহাম্মাদ আমার মত ও তার নিজের মত পরিহার করে শিশুদের মত গ্রহণ করে। এ কথা বলে সে নিজে কেটে পড়ল এবং তার সাথে আরো অনেকেই কেটে পড়ল। এসব মুনাফেকদের অনেকেই ইতিপূর্বে মুনাফেক ছিল না। তারা ছিল মুসলিম। তাদের ঈমানের আলো এত উজ্জ্বল ছিল যে, আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে তার দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। তারা যদি উহুদ যুদ্ধের পূর্বে অথবা নিফাকী প্রকাশ পাওয়ার পূর্বে মারা যেতো, তাহলে তারা ইসলামের উপরেই মৃত্যু বরণ করতো। আর এ মুনাফেকরা কখনো প্রকৃত মুমিন ছিল না। প্রকৃত মুমিনদেরকে পরীক্ষায় ফেলার পরও তারা ঈমানের উপর টিকে ছিল। তারা ঐসব মুনাফেকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না, যারা ফিতনায় নিপতিত হয়ে ঈমান ছেড়ে দিয়ে মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। শাইখের কথা এখানেই শেষ।

মোটকথা মুছীবতের সময় لو শব্দ উচ্চারণ করা ঐসব মুনাফেকদের স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত, যারা তাক্বদীরের ফায়ছালার উপর ঈমান আনে না। মুসলিম যখন বিপদাপদ ও মুছীবতে আক্রান্ত হবে, তখন সে যেন এ শব্দটি উচ্চারণ করা থেকে দূরে থাকে। সে যেন এ শব্দের পরিবর্তে এমন ভালো শব্দ উচ্চারণ করে, যাতে আল্লাহর নির্ধারণের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, ধৈর্য ধারণ করা ও ছাওয়াবের আশা করার অর্থ বিদ্যমান থাকে।

মুসলিম শরীফে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরণের শব্দের প্রতিই নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন,

الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِى كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلاَ تَعْجِزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَىْءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أَنِّى فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا. وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ

‘‘শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিনের চেয়ে অধিক ভালো ও প্রিয়। তবে প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে। যে জিনিস তোমার উপকার সাধন করবে, তা অর্জন করার জন্য আগ্রহী হও এবং কেবল আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাও। আর এ রকম যেন না হয় যে, তাক্বদীরের উপর ভরসা করে হাত গুটিয়ে অপারগ-অক্ষম হয়ে বসে থাকবে। কল্যাণকর ও উপকারী জিনিস অর্জনে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করার পরও যদি তোমার উপর কোনো বিপদ এসে পড়ে, তবে কখনো এ কথা বলো না, যদি আমি এ রকম করতাম, তাহলে অবশ্যই এমন হতো; বরং তুমি বলো, আল্লাহ যা তাক্বদীরে রেখেছেন এবং আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন তাই হয়েছে। কেননা ‘যদি’ কথাটি শয়তানের কুমন্ত্রণার পথ খুলে দেয়’’।[1]

আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের জন্য যেসব আমল ওয়াজিব, মুস্তাহাব কিংবা বৈধ করেছেন, তা থেকে যা করলে বান্দার দুনিয়া ও আখিরাতে উপকার হবে নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রতি নির্দেশ প্রদান করেছেন। এসব কাজ করার সময় বান্দা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে। যাতে করে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার কাজ পূর্ণ করেন এবং তিনি তার মঙ্গল করেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলাই বান্দার কর্মের স্রষ্টা এবং তিনি কর্মের ফলাফলেরও স্রষ্টা। উপায়-উপকরণ অবলম্বন করে কর্ম সম্পাদন করা এবং আল্লাহ তা‘আলার উপর পূর্ণরূপে ভরসা করার মধ্যে রয়েছে তাওহীদের বাস্তবায়ন। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপারগ, অক্ষম ও দুর্বল হতে নিষেধ করেছেন। উপকারী আমল বর্জন করার মাধ্যমেই বান্দা অপারগতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করে থাকে। উপকারী আমলের বিপরীত করার নামই অপারগতা-অক্ষমতা। উপকারী আমল করতে আগ্রহী হওয়া এবং এর জন্য পরিশ্রম করার পরও যদি তার উদ্দেশ্যের বিপরীত হয় অথবা অপ্রিয় কিছু অর্জিত হয়, তাহলে সে যেন না বলে, আমি যদি এমন করতাম, তাহলে অবশ্যই এমন হতো। কেননা এ ধরণের কথা কোনো উপকারে আসে না। এগুলো কেবল শয়তানের পথই সহজ করে দেয়। সেই সঙ্গে আফসোস করা এবং তাক্বদীরকে দোষারোপ করার প্রবণতা সৃষ্টি করে। আর এটি ধৈর্য ধারণ করা ও তাক্বদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার পরিপন্থী।

মোটকথা মুছীবতে সবর করা ওয়াজিব। তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ফরয। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়নের প্রতি নির্দেশনা প্রদানকারী এবং উপকারী শব্দ উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন। বান্দা বলবে, قدر الله ما شاء فعل ‘‘এটিই আল্লাহর নির্ধারণ, তিনি যা ইচ্ছা করেছেন, তাই করেছেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যা নির্ধারণ করেছেন, তা হবেই। এ ক্ষেত্রে আবশ্যক হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত ফায়ছালা মেনে নেয়া। আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা সম্পন্ন করেন। আর আল্লাহ তা‘আলার কাজসমূহ হিকমত থেকে খালী নয়।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, বান্দার কোনো জিনিস যখন হাতছাড়া হয়ে যায়, তখন তার দু’টি অবস্থা হতে পারে।

(ক) দুর্বলতা, অসহায়ত্ব ও অপারগতা এবং অক্ষমতার প্রকাশ করার অবস্থা। এটি শয়তানের রাস্তা খুলে দেয়। দুর্বলতা, অসহায়ত্ব ও অক্ষমতা-অপারগতা প্রকাশ করার কারণেই لو শব্দ উচ্চারিত হয়। আসলে لو শব্দ উচ্চারণে কোনো উপকারীতা নেই। বরং এটি দোষারোপের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। আর দ্বিতীয়

(খ) অবস্থা হলো উদ্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া এবং তার প্রতি খেয়াল করা। কাম্য বস্তুটি যদি তার জন্য নির্ধারণ করা হতো, তাহলে তাা কখনো তার হাতছাড়া হতো না এবং তাতে কেউ তাকে পরাভূত করতে পারতো না।

সুতরাং কাম্যবস্তু পাওয়া কিংবা না পাওয়ার অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি আলাইহি ওয়া সাল্লাম বান্দাকে উপকারী কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি لو বলতে নিষেধ করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, সেটা শয়তানের পথ খুলে দেয়। সেই সঙ্গে তাতে রয়েছে হাত ছাড়া হওয়া জিনিসের জন্য অযথা আফসোস, দুঃখ-বেদনা, দুঃশ্চিন্তা-উদ্বেগ প্রকাশ করা এবং তাক্বদীরকে দোষারোপ করার প্রবণতা। এতে করে বান্দা গুনাহগার হয়। আর এটি শয়তানের কাজও বটে। এখানে স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, শুধু لو শব্দ ব্যবহার করার কারণেই যে গুনাহগার হবে, তা নয়; বরং এর সাথে বান্দার অন্তরে ঈমানের পরিপন্থী যেসব বিষয় বিদ্যমান থাকে এবং যেসব বিষয় শয়তানের পথ উন্মুক্ত করে, তার কারণেই বান্দা গুনাহগার হয়।

যদি বলা হয়, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তার সাহাবীদেরকে বিদায় হজ্জের বছর হজ্জের ইহরাম ভঙ্গ করে উমরায় পরিণত করার আদেশ করেছিলেন, তখন তিনিও তো لو শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে ইহরাম ভঙ্গ করেননি। কারণ তিনি কুরবানীর জন্তু সাথে নিয়ে এসেছিলেন। এ কথার জবাব হলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

لَوِ اسْتَقْبَلْتُ مِنْ أَمْرِي مَا اسْتَدْبَرْتُ مَا أَهْدَيْتُ

‘‘আমি এখন যা জানতে পেরেছি তা যদি পূর্বেই জানতে পারতাম তাহলে আমি কোরবানীর জন্তু সাথে আনতাম না’’।[2]

ভবিষ্যতে তিনি সুযোগ পেলে যা করবেন, সে সম্পর্কে এখানে একটি খবর দেয়া হয়েছে। তাক্বদীরের উপর কোনোভাবেই আপত্তি করা হয়নি। বরং এখানে তিনি তার সাথীদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি যদি আগে শুধু হজ্জের ইহরাম বাঁধতেন, তাহলে কুরবানীর জন্তু সাথে আনতেন না। বরং শুধু উমরার ইহরাম বাঁধতেন। তিনি যখন সাহাবীদেরকে হজ্জের ইহরাম ভঙ্গ করে উমরা করার পর হালাল হয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন, তখন তিনি দেখলেন যে তারা এ নির্দেশ পালনে বিরত রয়েছে। তাই তিনি উৎসাহ দিয়ে তাদের মনকে খুশী করার জন্যই উপরোক্ত কথা বলেছেন।

সুতরাং এখানে لو শব্দ ব্যবহার করা মোটেই দোষণীয় ছিল না। বরং ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে যা করবেন, এখানে সাহাবীদের জন্য তিনি তাই ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং এ অর্থে لو ব্যবহার করা বৈধ হওয়াতে কোনো মতভেদ নেই। তাক্বদীরের প্রতি আপত্তি করতে গিয়েই কেবল لو ব্যবহার করার নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।


[1]. সহীহ মুসলিম ২৬৬৪, অধ্যায়: শক্তিশালী হওয়া এবং অপারগতা প্রকাশ বর্জনের আদেশ।

[2]. সহীহ বুখারী ১৬৫১, সুনানুল কুবরা বাইহাকী।